সাধু ভাষা কাকে বলে? – snigdhasokal.com

সাধু ভাষা কাকে বলে?

সাধু ভাষা কাকে বলে? - snigdhasokal.com

বাংলা ভাষার বিখ্যাত সাহিত্যিক ও গবেষক ড. এনামুল হকের মতে, –  “বাংলা ভাষার সংস্কৃত শব্দ সম্পদ, ক্রিয়া ও সর্বনাম পদের পরিপূর্ণ এবং ব্যাকরণসিদ্ধ  উপাদান ব্যবহার করিয়া ইংরেজি গদ্য সাহিত্যের পদবিন্যাস প্রণালির অনুসরণে পকিল্পিত  যে নতুন সর্বজনীন গদ্যরীতি বাংলা সাহিত্যে প্রবর্তিত হয়, তাকে বাংলা সাধু ভাষা বলে।”
আরো পড়ুনঃ কারক কাকে বলে?

সাধু ভাষার বৈশিষ্ট্যঃ

নিচে সাধু ভাষার কিছু বৈশিষ্ট্য দেওয়া হলো-
  • সাধু ভাষা সুনির্ধারিত ব্যাকরণের অনুসারী। এর কাঠামো অপরিবর্তনীয়। এর পদবিন্যাস সুনিয়ন্ত্রিত ও সুর্দিষ্ট।
  • এটা লেখ্য ও আদর্শ সাহিত্যিক ভাষা  এবং সর্বজন বোধ্য কিন্তু ‍কৃত্রিম কোনো অঞ্চলের ভাষা নয়।
  • সাধু রীতিতে তৎসম (সংস্কৃতি) জাত শব্দের ব্যবহার অধিক। তািই এটা পাণ্ডিত্যপূর্ণ ও পুরনো বৈশিষ্ট্যজাত।  
  • সাধু ভাষা কথোপকথন ( কথাবার্তা ), নাটক, সংলাপ, বক্তৃতা ইত্যাদির ক্ষেত্রে অনুপযোগী।
  • সাধারণত পূর্ণ ক্রিয়াপদ সম্বলিত যে গুরুগম্ভীর কৃত্রিম রীতি কেবল লেখার ক্ষেত্রে ব্যবহার করা হয় তাকে সাধু ভাষা বলে। যেমন- আমি ভাত খাইয়াছি।
  • সাধু ভাষায়  সমাপিকা ও অসমাপিকা ক্রিয়াপদগুলো পূর্ণরূপে ব্যবহৃত হয়। যেমন – করিয়া, করিয়াছি, পড়িয়া, পড়িয়াছি, বলিয়া, বলিয়াছি, করিতেছি  ইত্যাদি।
  • সাধু ভাষায় সর্বনাম পদগুলো পূর্ণরূপে ব্যবহৃত হয়। যেমন – এই, সেই , ইহারা, তাহারা , তাহাকে, তাহাতে ইত্যাদি।
  • অনুসর্গ ব্যবহারের ক্ষেত্রে সাধু ভাষায় তৎসম শব্দের প্রাধান্য বেশি। যেমন- থাকিয়া, হইতে, দিয়া ইত্যাদি।
  • সাধু ভাষায় সংস্কৃত অব্যয়গুলো অধিক রূপে ব্যবহৃত হয় । যেমন- যদপি , বরঞ্চ, তথাপি, অদ্য ইত্যাদি।
  • সাধু ভাষা কৃত্রিম ও পরনো বৈশিষ্টেরর অনুসারী।
  • সাধু ভাষা কথাবর্তার উপযোগী নয় এবংয় গুরুগম্ভীর ভাবপূর্ন হওয়ায় তা ক্রমশ জনবিচ্ছিন্ন হয়ে পড়ে। এ ভাষা আধুনিক যুগে প্রায় বর্জিত হতে চলেছে।
  • সাধু ভাষা ঐতিহ্যমণ্ডিত ও সমৃদ্ধ হলেও সকলে বোধগম্য নয়।
  • সাধু ভাষা  ধ্বন্যাত্মক  শব্দের ব্যবহার নেই।
  • সাধু ভাষা প্রাচীন।
আরো পড়ুনঃ সমাস কাকে বলে?

সাধু ভাষার কিছু উদাহরণঃ

১। বহুদিন ঘন বর্ষার পরে আজ মেঘমুক্ত আকাশে রৌদ্র দেখা  দিয়াছে । নৌকায় আসীন অপূর্বকৃষ্ণের মনে ভিতরকার এককানি ছবি যদি দেখেতে পাতিাম তবে দেখিতাম, সেখানেও েএই যুবকের মানসনদী নববর্ষায় কূলে কূলে ভরিয়া আলোকে জল জল এবং বাতাসে ছল ছর করিয়া উঠিতেছে।
…………………..[সমাপ্তি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর ]
২।জলের ধারে তীরে তীরে, মাঠে মাঠে রাখালেরা গুরু চারাইতেছে, কেহ বা বৃক্ষ তলায় বসিয়া গান করিতেছে, কেহ বা তামাক খািইতেছে’; কেহ বা মারামারি করিতেছে, কেহ বা ভুজা খাইতেছে। কৃষকেরা লাঙ্গল চষিতেছে, গুরু ঠৈঙ্গাইতেছে, গরুকে মানুষের অধিক করিয়া গালি দিতেছে। .. ঘাটে ঘাটে কৃষকের মহিষীরাও কলসী, ছেঁড়া কাঁথা, পচা মাদুর, রূপার তাবিজ, নাক ছবি, পিতলের  টৈছে, দুই মাসের ময়লা পরিধেয় বস্ত্র, মসী নিন্দিত গায়ের বর্ণ, রুক্ষ কেশ লইয়া বিরাজ করিতেছে।
…………………..[বিষবৃক্ষ: বঙ্কিমচন্দ্র।]
৩।সেই রাতে চৌকিদার থানায় গিয়া সংবাদ দিল  যে, প্রসাদপুর কুঠিতে খুন হইয়াছে। সৌভাগ্যবশত থানা সে স্থান হইতে ছয় ক্রোশের ব্যবধান। দারোগা আসিতে পরদিন বেলা প্রহর হইল। আসিয়া তিনি খুনের তদারকে প্রবৃত্ত হইলেন। রীতিমত সরতহাল ও লাশ -তদারক করিয়া রিপোর্ট পাঠাইলেন। পরে রোহিনীর মৃতদেহ বাঁধিয়া ছাদিয়া, গরুরর গাড়িতে উঠাইয়া চৌকিদারের সঙ্গে  সঙ্গে ডাক্তারখানায় পাঠাইলেন পরে স্নান করিয়া আহারাদি করিলেন।
………………….[বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়]

বাংলা ভাষার কয়েকটি আঞ্চলিক রূপঃ

সর্বজনীন রূপ      : একজন মানুষের দুটি ছেলে ছিল।
ঢাকা অঞ্চল         : একজন  মানসের দুইডা পোলা আছিল।
নোয়াখালী অঞ্চল : একজনের দুই হুত আছিল।
মেদেনীপুর অঞ্চল : এক লোককার দুট্ট পো আইল।
ময়মনসিংহ অঞ্চল : এ্র্যকজনের দুই পুত আছিল।
খুলনা অঞ্চল         : এ্যাকজন মানশির দুটো ছাওয়াল ছিলো।
বরিশাল অঞ্ছল      : এ্যকজন মানুষের দুগগা পোলা আললে।
রংপুর অঞ্চল        : এ্যাকজোন মানষের দুই কা ব্যাটা  আছিল।
রাজশাহী অঞ্চল    : এ্যাক ঝোন মানুষের দুটা ব্যাটা ছৈল আছলো।
চট্টগ্রাম অঞ্চল      : উগগা মাইনশর দুয়া পোয়া  আছিলো।
সিলেট অঞ্চল       : কোন মানুশর দুই পুয়া আছিল।


আরো পড়ুনঃ সনেট কাকে বলে?

সাধু ও চলিত রীতির বিকাশ ও শ্রীবৃদ্ধিকালঃ

অনুসন্ধানে দেখা যায় যে, বাংলা লেখ্য সাধুরীতির নমুনা মধ্যযুগের সামান্য দলিল ও দস্তাবেজে পাওয়া গেলেও বাংলা গদ্যরূপ  ইংরেজদের  আগমনের প রে বিকাশ লাভ করেছে।
ঊনবিংশ শতাব্দীর রামমোহন এবং ফোর্ট উইলিয়াম কলেজ গোষ্ঠীর হা তে বাংলা সাধু ভাষার চর্চা সূচিত হয়। এ ভাষা তখন সমগ্র বাংলা ভাষাভাষী অঞ্চলের সাহিত্যিক ভাষারূপেও ব্যবহৃত হতো। এর পরে ঈশ্বরচন্দ বিদ্যাসাগর, অক্ষয়কুমার, ভূদেব চন্দ্র, সাহিত্য সম্রাট বিঙ্কমচন্দ্র, মাইকেল মধূসূদন দত্ত, রামেন্দ্র সুন্দর, মীর শমশাররফ হোসেন প্রমুখ খ্যাতিমান লেখকের হাতে যথেষ্ট সমৃদ্ধি লাভ করে।  এ সময় বেশ কিছু সাহিত্য রচিত এবং  সুধী সামজে তা বিশেষভাবে আদৃত হয়্।
অতঃপর ঊনবিংশ শতাব্দী হতে  সাম্প্রতিককাল পর্যন্ত বাংলা চলিত ভাষায় উৎকৃষ্ট ধরণের সাহিত্যচর্চা হচ্ছে। এক্ষেত্রে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর, বিবেকানন্দ, প্রমথ চৌধুরী , সৈয়দ মুজতবা আলী প্রমুখসহ আধুনিক লেখক গোষ্ঠী চলিত ভাষার অনুরাগী। তাই চলিত ভাষার  বর্তমান সমৃদ্ধির কাছে সাধু ভাষা যেন দিন দিন ম্লান হতে ম্লানতর হয়ে যাচ্ছে। বাংলা ভাষায় শক্তির সন্ধান করতে উইলিয়াম কেরী ( দৃষ্টান্ত ’কথোপকথন -১৮০১) খুব সচেষ্ট ছিলেন।

Related Articles

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Back to top button