বাংলা ভাষার উৎপত্তি ও ইতিহাস – snigdhasokal.com
বাংলা ভাষার উৎপত্তি ও ইতিহাসঃ
আমরা যে আজকের এই বাংলা ভাষায় কথ বলি আপনি জানেরন এই বাংলা ভাষা উৎপত্তি সম্পর্কে। যদি না জেনে থাকেন তাহলে আজকের এই পোস্টটি আপনার জন্য। পোস্টটির শুরু থেকে শেষ পর্যন্ত পড়ে আপনি বাংলা ভাষার উৎপত্তি সম্পর্কে জানতে পারেন।
বাংলা ভাষার উৎপত্তির ইতিহাসঃ
বাংলা ভাষার প্রকৃত উৎপত্তিকাল নির্ণয় করা খুবই কঠিন। কারণ, এ সম্পর্কে ভাষা বিজ্ঞানীগণ কোনো সিদ্ধান্তে স্থিরভাবে উপনীত হতে পারেন নি, তািই এ বিষয়ে নানা মত প্রচলিত আছে। বাংলা ভাষার মূল অনুসন্ধান করে ভাষা বিজ্ঞানীরা সিদ্ধান্তে উপনীত হয়েছেন যে, বাংলা ভাষা ইন্দো -ইউরোপীয় মূল ভাষা গোষ্ঠীর অন্তর্গত। আনুমানিক খ্রিস্টপূর্ব ৫০০০ বছর আগে পূর্ব ইউরোপ ও মধ্য এশিয়ার পশ্চিমে প্রচলিত ছিল এই ইন্দো – ইউরোপীয় মূল ভাষা। এর ছিল দুটি শাখা- কেন্তমও শতম। শতম ভাষার অন্যতম উপশাখা গোষ্টী হলেঅ আর্য । খ্রিস্টপূরর্ব পনেরো শতকের পূর্বে ইরানের ( পূর্বতন পারস্য) মধ্য দিয়ে এ আর্যজাতি এ দেশে আগমন করে। তাদের একটি শাখা ইরানে বসতি স্থাপন করে। আর অপরটি এ ভারতীয় উপমাহদেশে স্থায়ীভাবে বসবাস কররতে আসে। এরাই ভারতীয় আর্য নামে খ্যাত। তারা যে ভাষায় কথা বলত, সে ভাষায় কথা বলত, সে ভাষার নাম ছিল ‘বৈদিক সংস্কৃত ‘ বা ছন্দস । তারপর আরে অনেক আর্য উপজাতি বিভিন্ন সময়ে তাদের আঞ্জলিক ভাষা সাথে করে নিয়ে এ উপমাহদেশে আসে। একই জাতি হওয়া সত্ত্বে ও বিভিন্ন উপজাতির ব্যবহৃত কথ্য ভাষায় বেশ পার্থক্য ছিল। তাই তাদের এসব উপজাতীয় বৈদিক সংস্কৃত ভাষা সব আর্যের গ্রহণযোগ্য করে প্রাচীন ভারতীয় আর্যভাষা নামে একটি সাহিত্যিক ভাষা হিসেবে প্রতিষ্ঠা লাভ করে। কালক্রম তাদের এ ভাষা শক্তিশালী হিসেবে পরিগণিত হয়। এই কাল ছিল ১২০০ খ্রিস্ট পূর্বাব্দ। এ ভাষার নিদর্শন পাওয়া যায় আর্যদের ‘ঋগবেদের সংতিায়’ । আর্যরা এ উপমহাদেশে প্রবেশ করে প্রথমে বসতি স্থাপন রে বর্তমান পাঞ্জাব অঞ্চলে । সেখানে থেকে তারা ক্রমশ পূর্বদিকে বিস্তার লাভ করতে থাকে।
সে সময়ে এ উপমহাদেশে বাস করতো এক উন্নত সভ্যতার শান্তিপ্রিয় জাতি। তাদের নাম ছিল ‘দ্রাবিড়’ ও কোলজাতি। এদেরকে আবার ‘অনার্যও’ ও বলা হতো। এদেরও ছিল শক্তিশালী ভাষা। এরা যুগের পর যুগ এ ভূখন্ডে শান্তিপূর্ণভাবে বসবাস করে এবং তারা যুদ্ধ াব কলহপ্রিয় জাতি ছিল না। কিন্তু আর্যরা ছিল যুদ্ধপ্রিয় জাতি । তারা এ দেশে এরস অনার্যদের আক্রমণ করে এবং তাদে সভ্যতা ধ্বংস করে ফেলে ্ ফলে এর বন জঙ্গলসহ দূর লোকালয়ে পালিয়ে যায় । আর্যরা এখানে বাসতি করে এবং নিজস্ব সভ্যতা বিকাশ সাধন করতে থাকে। তাদের বৈদিক বা আর্যভাাস শক্তিশালী হতে আরও পূর্বদিকে অগ্রসর হয়ে উত্তর বিহার পর্যন্ত বিস্তৃৃতি লাভ বরে। এভাবে দেশেরে সুবস্তৃত অঞ্চলে আর্যভাষা ছড়িয়ে পড়ে। ফলে আর্য ও অনার্য ভাষাগুলোর সংমিশ্রণ হয়ে এক নতুন ভাষার সৃষ্টি হয় এবং না হয় মধ্র ভারতীয় আর্য ভাষা। এ ভাষা প্রথম পর্যায়ে ‘পালি’ ও পরে ‘প্রাকৃত’ ভাষা নামে চিহ্নত হয়।
প্রকৃতি বা প্রাকৃত মানে সাধারণ মৌখিক ভাষা। এ ভাষা সাধারণত মানুষের মুখে নিত্র অপরিবর্তিত হতে থাকে এবং অঞ্চলভেদে কয়েক ভাগে বিভক্ত হয়ে যায়। এটা মহারাষ্টে মহারাষ্ট্রী, সুরসেনে সৌরসেনী, মগধে মাগধী, গৌড়ে গৌড়ি প্রভৃতি নামে অভিহিত হতে থাকে।
এ প্রকৃত ভাষা কালে কালে বদলে যেতে থাকে। এই বদগুলোর নাম হলো আাদি প্রাকৃত , মধ্য প্রাকৃত ও আন্ত প্রাকৃত। আন্ত প্রাকৃতকে পণ্ডিতরা আবার ‘অপভ্রংশ’ নাম দিয়েছেন। এই অপভ্রংশ থেকেই আধুনিক আর্যভাষা বা সংস্কৃত, বাংলা, উড়িয়া, ভোজাপুরি, অসমিয়া, মৈথিলি প্রভৃতি ভাষার জন্ম হয়।
এখানে একটি বিষয় উল্লেখ না করলে ই নয়, তা হলো এ উপমহাদেশে আর্যরা যে বৈদিক ভাষা ব্যবহার করতো,তা ছিল একটি সাহিত্যিক ও ধর্মীয় ভাষা। এ ভাষার প্রচলন কেবল সমাজের উঁচু শ্রেণির মধ্যে সীমাবদ্ধ ছিল। সাধারণের চর্চার কোনো বিশেষ সুযোগ ছিল না। তাই হয়তো আর্য -অনার্য ভাষার সংমিশ্রণে এই প্রকৃত িবা প্রাকৃত ভাষার জন্মলাভ বেশি সহায়ক ভূমিকা পালন করেছিল। যাই হোক, মাগধী ভাষার প্রাচ্যতর রূপ গৌড়ি প্রাকৃৃৃৃৃৃৃত। আর এই গেওড়ি পাকৃত হতে পরবর্তী স্তর গৌড় অপভ্রংশ হতে বংল া ভাষার উৎপত্তি। গৌড় অপভ্রংশ হতে সর্বপ্রথম বিহারী ভাষা উৎপন্ন হয় ও তা পৃথক হয়ে যায়। এর পর উড়িয়া ভাষা, এরপর কামরূপী ভাষা। এ কামরূপী ভাষা আবার দুৎভাগে বিভক্ত হয়ে বাংলা ও অসমিয়া ভাষায় পরিণত হয়েছে। অর্থাৎ এ কথা নিশ্চিতভাবে বলা যায় যে, মাগধী বা গৌড়ি অপভ্রংশ থেকেই বাংলা ।ভাষার জন্ম এ বিষয়ে কোনো সন্দেহ নেই । তবে বাংলাভাষায় এ বিবর্তন ৃপ্রায় হাজার বছরের ইতিহাস।
তাই ভাষাপণ্ডিতরা বাংলা, বিহারি, উড়িয়া, অসমিয়া ভাষাকে নব্য ভারতীয় আর্যভাষা হিসেবে গণ্য করেন। কারণ, এ নব্য ভারতীয় আর্যভাষা ্আবার দু’ভাগে বিভক্ত হয়ে বাংলা ও অসমিয়া ভাষায় পরিণত হয়েছে। অর্থাৎ এ কথা নিশ্চিতভাবে বলা যায় যে , মাগধী বা গৌড়ি অপভ্রংশ থেকেই বাংলা ভাষার জন্ম এ বিষয়ে কোনো সন্দেহ নেই। তবে বাংলাভাষায় এ বিবর্তন প্রায় হাজার বছরের ইতিহাস।
তাই ভাষাপণ্ডিতেরা বাংলা, বিহারি, উড়িয়া, অসমিয়া ভাষাকে নব্য ভারতীয় আর্যভাষা হিসেবে গণ্য করেন। কারণ, এ নব্য ভারতীয় আর্যভাষা গোষ্ঠীর মধ্যে পারস্পরিক নিবিড় সম্পর্ক বিদ্যমান।
প্রাকৃত ভাষার ম্রেদ্য প্রাচীন ভারতীয় আর্য ভাষা যাতে হারিয়ে না যায় , তার জন্য পণ্ডিতগণ প্রাকৃত ভাষার ওপর গবেষণা চালিয়ে প্রাচীন আর্যভাষাকে পুনরায় উদ্ধার ও সংস্কার ক েএকটি আদর্শ ভাষার সৃষ্টি করেছন। সংস্কৃার জাত বলে এর নাম দেয়া হয়েছে সংস্কৃত ভাষা। এখানে বলা দরকার যে , প্রচাীন ভারতীয় আর্যভাষাকে ‘বৈদিক আর্য’ বা বৈদিক সংস্কৃত ‘ভাষা বলা হয়।
বাংলা ভাষার যুগ বিভাগঃ
ড. মুহম্মদ শহীদুল্লাহ উল্লেখ করেন যে, বাংলা ভাষার প্রথম লিখিত নিদর্শন পাওয়া যায় ৬৫০ খ্রিস্টাব্দে থেকে। এ সময়ে বৌদ্ধ সিদ্ধাাচার্য নামে এক ধরনের সন্নাসী কর্তৃক রচিত চর্যাপদ বা ছো আকারের কবিতা/গান (চর্যাপদের প্রথম কবি মনিনাথ) রচনাকাল ধরে তিনি ৬৫০ খ্রিস্টাব্দ থেকে বাংলা ভাষায় উৎপত্তি অনুমান করেন্ অপরদিকে
ড. সুনীতিকুমার চট্টোপাধ্যায় ৯৫০ খ্রিস্টাব্দ থেকে বাংলা সাহিত্যের উৎপত্তিকাল বলে মনে করেন।
বাংলা ভাষার জন্মকালঃ
তবে বাংলা ভাষার জন্ম হয়েছে আজ হতে প্রায় এগারে শ বছর আগে – এ কথায় প্রায় সকল ভাষা পন্ডিত একমত পোষন করেন। প্রাকৃত ভাসার স্তর পার হেয় গৌড়ীয় প্রাকৃতের ভেতর দিয়ে এ ভাষা পরিপুষ্ট হয়েছে। তবে সংস্কৃতের কাছেই এ ভাষা বেশি ঋণী। তাই বলে এ ভাষাকে কোনো অবস্থাতেই সংস্কৃতের দুহিতা হিসেবে কেউ কেউ আখ্যায়িত করতে চােইলেও তা ধোপে টিকে না। কারণ , প্রাচীন ও মধ্যযুগের সাহিত্য সৃষ্টিসমূহ ঘাটলেই তার যথার্থ প্রমাণ পাওয়া যায়।
বাংলা ভাষার যুগবিভাগঃ
সময়ের বিবর্তনের ধারা অনুসারে বাংলা ভাষাকে চারটি যুগে ভাগ করা যায়। যথাঃ-
- আদি বা প্রাচীন যুগ।
- মধ্যযুগ
- আধুনিক যুগ
- আর্ত আধুুনিক যুগ
১. আদি বা প্রাচীন যুগঃ
(৯০০/৯৫০ – ১২০০) : এ যুগের কবিদের মধ্যে কবি নীননাথ, কাহ্নপা, ভুসুকুপাদ, ডোম্বাপাদ প্রমুখ কবির রচিত বেওদ্ধগান, দোহা নামক চর্যাপদগুলোতে প্রাচীন বাংলা ভাষার নিদর্শন পাওয়া যায়। এ ভাষা থেকে তখন পর্যন্ত তার পূর্ববর্তী অপভ্রংশ প্রভাব দূর হয়ে যায় নি। এমনকি প্রাকৃতিক প্রভাবও তাতে বিদ্যমান ছিল। এতে বৌদ্ধ সিদ্ধাচার্যদের ধর্মমতের গোপন রহস্য ( চর্যাপদ) স্থান পেয়েছে।
২. মধ্যযুগঃ
(১২০০ – ১৮০০ খ্রিস্টাব্দ০: এ যুগে চন্ডীদাসের ‘শ্রীকৃষ্ণকীর্তন’, মালাধর বসুর ‘শ্রীকৃষ্ণ বিজয়’, কৃত্তিবাসের ‘রামায়ণ পাচালী’, কবীন্দ্র -পরমেশ্বর -শ্রীকর নন্দীর ‘ মহাভারত’ নারায়ণদেবের ‘বিপ্রদাস’, বিজয়গুপ্তের ‘ মনসামঙ্গল কাব্য’ মানিক দত্তের ‘ চণ্ডীমঙ্গল’ , শাহ মুহম্মদ সগীরের ‘ ইউসুফ জুলেখা’ প্রভৃতি সাহিত্য সৃষ্টি বিকাশ লাভ করে এবং বাংলা ভাষাকে মধ্যযুগীয় সাহিত্যে বিকাশনার ধারায় নিয়ে আসে। এ যুগে মকুন্দরায়, জ্ঞানদাস, মুকুন্দদাস, বিদ্রাপতি, আলাওল, সৈয়দ সুরতান, মোহাম্মদ মুকিম, আব্দুল হাকিম প্রমূখ ছিলেন বরেণ্য কবি।
এ যুগের বৈষ্ণব সাহিত্য ও পৌরাণিক অনুবাদ সাহিত্যে মাধ্যমে বাংলঅ ভাষায় প্রচুর তৎসম শব্দ স্থান পায়।
এ যুগের আর এক দিকপাল হ লেন শ্রী চৈতেন্য দেব ( ১৪৮৬ -১৫৩৩ খ্রি.)। তার আবির্ভাবের ফলে বাংলা ভাষার সৌন্দর্য ও সম্পদ যেন ক্রমান্বয়ে আত্ম প্রকাশ করতে থাকে এবং তার পূর্ণ বিকাশ ঘটে ১৭০০ থেকে ১৮০০ শতকের দিকে। ষোড়শ – সপ্তদশ শকক থেকেই বাংলা ভাষায় আরবি, ফারসি শব্দসম্ভার শাসনকার্যে, সমাজজীবনে ও সাহিত্যসহ জীবনের সর্বত্রই প্রভাব বিস্তার করতে থাকে। মধ্যযুগের শেষ কবি ভাতচন্দ্র রায় গুণাকর তার সাহিত্যকর্মে প্রচুর আরবি, ফারসি শব্দ ব্যবহার করেন এবং তার হাতেই বাংলঅ ভাষা মার্জিত রূপলাভ করে। মধ্যযুগের দ্বিতীয়ার্ধে প্রতিভাশীল কবিদের আবির্ভাব হয়। এ সময়ে বাংলা সাহিত্যে বলতে যডা বোঝায় , াত সবই কাব্য। যেমন- পদাবলি, মঙ্গলকাব্য, অনুবাদ কাব্য , মানবিক প্রণয় কাব্য ইত্যাদি। এ সময়ে গদ্য সাহিত্য ছিল না বললে ই চলে ্। তবে ষোড়শ শতক থেকে চিঠিপত্র, দলিল দস্তাবেজ গদ্যরীতিতে লেখা হতো।
৩. আধুনিক যুগঃ
(১৮০১ – ১৯৩০) : এ যুগে বাংলা ভাষা তার নব পর্যায়ের প্রথম ধাপে প্রবেশ করে। গদ্য সাহিত্য পথিকৃঃ বঙ্কিম যুগ, ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগরীয় যুগে প্রবেশ করে বাংলা সাহিত্যে নবরূপ পরিগ্রহণ করে। আধুনিক যুগে বাংলা কিবতা কাব্যের পাশাপাশি গদ্য বিকাশ সাধিত হয়েছে। বিশেষ করে ১৮০০ শতাব্দী হলো বাংলা গদ্যের বিশেষ উৎকর্ষের যুগ। এ সময়ের কাব্যের পাশপাশি গদ্যবির্ভর সাহিত্য, নাটক, উপন্যাস, প্রবন্ধ, ছোটগল্প, সমালোচনা ইত্যাদি রচিত হতে থাকে। একের পরে এক । ছাপাখানার বদৌলতে বাংলা ভাষার বা সাধুরীতিতে গদ্য সাহিত্য রচিত হতে থাকে। সাধু রীতির পাশাপাশি প্রচুর ইংরেজি শব্দের ব্যবহার ঘটে িএবং সংস্কৃত শব্দ বর্জন করা হয়। আর চলিত ভাষায় সংক্ষিপ্ত ক্রিয়াপদ ও সর্বনাম পদ ব্যবহৃত হতে থাকে। ফলে বাংলা ভাষায় নানা শব্দ ও বাক্য বিন্যাসে বৈচিত্র্য দেখা যায়।